অনিয়ন্ত্রিত লোভ ও ক্ষমতার অপব্যবহারে কোণঠাসা সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা ------- মিলন দাস

অনিয়ন্ত্রিত লোভ ও ক্ষমতার অপব্যবহারে কোণঠাসা সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা

(২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সংক্ষেপে পুঁজির চাপে কোণঠাসা হচ্ছেন সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা শিরোনামে গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত।)    

মিলন দাস।     

পুঁজির খপ্পরে সুন্দরবন। পর্যটন শিল্পের বাড়বাড়ন্তে বিপন্ন বাদাবনের জীব বৈচিত্র্য। বন দপ্তরের কুশাসনে উৎখাতের পথে এলাকার দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষজন। জীবন-জীবিকার ওপর প্রতিনিয়ত হামলা চালানো হচ্ছে। এলাকার মানুষের চিরায়ত মাছধরা পেশার অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। আইনের নিত্যনতুন ফিকির তুলে মৎস্যজীবীদের বেঁচে থাকার জীবিকাকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে।* সুগম পর্যটনের লোভে সুন্দরবনের অনন্য বাস্তুতন্ত্রকে দিনের পর দিন ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।      

 

   আজ নিজভূমে পরবাসী হয়েছেন বাদাবনের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো। বনদপ্তরের অত্যাচার সামলে কোনোক্রমে টিকে আছেন তাঁরা। যত্রতত্র কাটা হচ্ছে বাদাবন। একের পর এক গড়ে উঠছে হোটেল। কনক্রিটের দেওয়ালের বাইরের দিকটায় মাটির প্রলেপ দিয়ে গড়ে উঠছে তথাকথিত বন্যপ্রাণপ্রেমী এনজিওগুলোর দান খয়রাতির অফিস গৃহের আড়ালে সপ্তাহান্তিক অবকাশের খামার বাড়ি। সারা বছরই পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে সেখানকার দৈন্যতা। ব্যাঘ্রবিধবাদের দুর্ভাগ্য আর তাদের পাড়াগুলি হয়ে উঠেছে পর্যটনের বিশেষ আকর্ষণ। পর্যটনকে প্রাধান্য দিতে ব্যাঘ্র প্রকল্প শিকেয় তুলে গভীর জঙ্গলে বনদপ্তরের অফিস ও ক্যাম্পগুলিতে বাদাবন কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে পর্যটকদের জন্য অতিথিশালা, ওয়াচ-টাওয়ার ইত্যাদি। দূষণের নামে মৎস্যজীবীদের মেশিন নৌকা ব্যবহারে বাধা দেওয়া হলেও প্রমোদ যানের ভারী ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়ার বিরাম নেই। আইনি বাধ্যবাধকতা শুধুই যেন ওই সব গরিব মানুষদের জন্য। পর্যটন শিল্প আর কিছু এনজিওর শ্রীবৃদ্ধির জন্য সব কিছুই যেন খুল্লাম খুল্লা।

 

সুন্দরবন থেকে বনজীবীদের বঞ্চিত করে উৎখাত করার যে প্রক্রিয়া ১৯২৮ সালে ঔপনিবেশিক শাসনে শুরু হয়েছিল তা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সমান তালে চলছে। তবুও সেই বহমান ষড়যন্ত্রের মধ্যে দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে ছিলেন সেখানকার মানুষ। কিন্তু শেষ পেরেকটি যেন পুঁতে দিতে নেমেছে বর্তমান রাজ্য সরকার।

   এখন মাতলা, রায়দিঘি ও রামগঙ্গা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত রিজার্ভ ফরেস্টের ১০৪৪.৬৮ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চলকে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের চিফ ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেনের প্রস্তাব [no. 306/WLI2W-80(2)/2023 dated 20.12.2023], যা কিনা ন্যাশনাল টাইগার কনজার্ভেশন অথরিটির অনুমোদন [F. No. 15-30(5)/2023-NTC New Delhi, the January 17, 2024] পেয়েছে, সেই প্রস্তাবে জঙ্গল নির্ভর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কী হবে তা নিয়ে রাজ্য সরকারের যৎসামান্য ভাবনার লেশও চোখে পড়ে না। পাশাপাশি, কেন্দ্র-রাজ্যের এই যৌথ প্রয়াসকে সফল করতে তথাকথিত বন্যপ্রাণপ্রেমী সংগঠন আর পর্যটন শিল্পের পুঁজি একপ্রকার উঠে পড়ে লেগে পড়ল।

রিজার্ভ ফরেস্টের এই ১০৪৪.৬৮ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে মাতলা ও ঠাকুরান নদীর মধ্যবর্তী বনাঞ্চলে রয়েছে ৫৫৬.৪৫ বর্গ কিলোমিটার ওয়েস্ট সুন্দরবন ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি, আর বাকি অর্থাৎ ১০৪৪.৬৮ ৫৫.৪৫ = ৪৮৮.২৩ বর্গ কিলোমিটার মাছ ধরার জায়গা। সেই জায়গাটা সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ নিয়ে নিচ্ছে। তাহলে মৎস্যজীবীদের জন্য আর কী রইলো?  

বনদপ্তরের আধিকারিক আর তথাকথিত বন্যপ্রাণপ্রেমীদের উত্তর তৈরিকেনো, জেলেদের এত আশঙ্কা কীসের? রিজার্ভ ফরেস্টের ৪৮৮.২৩ বর্গ কিমি মাছ ধরার জায়গাটা সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভে মাছধরার জায়গা হিসাবেই থাকছে। শুধু নামটা বদলে হচ্ছে বাফার। 

 

কিন্তু এই আমলাতান্ত্রিক ফিকিরে মৎস্যজীবীদের আশঙ্কা কিছুতেই দূর হবে না। কেননা, তাঁরা জানেন, এর কিছুদিন পর সমগ্র বাফার সিটিএইচ (ক্রিটিক্যাল টাইগার হ্যবিট্যা) হয়ে যাবে। উৎখাত হতে হবে মৎস্যজীবীদের। যেমন করে ২০০৭ সালে সমগ্র কোর এরিয়ার পাশাপাশি সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সমগ্র খোলাবাদার ৩৬৯.৫৩ বর্গ কিলোমিটার অংশকে ক্রিটিক্যাল টাইগার হ্যবিটেট (Notification No. 6028-For, dated 18.12. 2007) ঘোষণা করে সেখান থেকে উৎখাত করা হয়েছে মৎস্যজীবীদের।

তাছাড়া, রিজার্ভ ফরেস্টের ওই ৪৮৮.২৩ বর্গ কিলোমিটার মাছ ধরার জায়গায় এতদিন জেলেরা মেশিন নৌকা নিয়ে মাছ ধরত, সেই জায়গাটা সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের মধ্যে ঢুকে বাফার হয়ে গেলে সেখানে তারা আর মেশিন নৌকা নিয়ে ঢুকতে পারবে না। কেননা, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভে মেশিন নৌকায় মাছ শিকারে অনুমতি নেইঅথচ, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সমস্ত নজরদারি বোট এবং পর্যটন পুঁজির বোট উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন না লাগিয়ে চলে না। তাতে কোন দোষ নেই? তাতে আইন ভঙ্গ হয় না?

 

   সুন্দরবন থেকে মৎস্যজীবীদের উৎখাতের ইতিহাস অবশ্য বেশ পুরানো। এটা একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। একটা চলমান ষড়যন্ত্রও। ঔপনিবেশিক কাল থেকে তা চলে আসছে। সেসময় উপনিবেশিক সরকার অবিভক্ত ২৪ পরগণার অন্তর্গত  সুন্দরবনের প্রটেকটেড ফরেস্টের ( যা প্রতিষ্ঠিত হয় ০৭-১২-১৮৭৮ তারিখে) বেশিরভাগ অংশকে  রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা (Notification No. 15340-For, dt. 09.08.1928) করে দিয়ে জঙ্গলে জীবিকা চালানোর উপর নিয়ন্ত্রণ অরোপ করেছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বসিরহাট রেঞ্জ। অবশিষ্ট যেটুকু প্রটেকটেড ফরেস্ট ছিল সেটুকু প্রায় পনেরো বছর পর রিজার্ভ ফরেস্ট বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয় (Notification No. 7737-For, dt. 29.05.1943)। প্রতিষ্ঠিত হয় নামখানা রেঞ্জ।

    রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা হওয়ার ফলে ভারতীয় সুন্দরবন জঙ্গলে স্বাধীনভাবে জীবিকা অতিবাহিত করার আর কোনও অধিকার রইলো না। কেননা, ১৯২৭ সালের ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট মোতাবেক জঙ্গলে বন্দুক নিয়ে যাওয়া, গবাদি পশু চরানো, গাছ কাটা, বনজ দ্রব্য সংগ্রহ, জমি পরিষ্কার নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু হয়েছিল। জীবিকা বলতে যেটুকু বেঁচে রইল সেটুকু ছিল শুধুমাত্র বনদপ্তরের অনুগ্রহে। 

 

এ সবই ঘটল উপনিবেশিক শাসনে। দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হল। কিন্তু এসবের অবসান হল না। স্বাধীন দেশের সরকার সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি-জঙ্গল থেকে মৎস্যজীবীদের উৎখাতের প্রথম পদক্ষেপ করল ১৯৭৩ সালে। কমবেশি ৪২৬৪ বর্গ কিলোমিটার সুন্দরবনের যে অংশে মাছ থাকে সবচেয়ে বেশি সেই অংশে অর্থাৎ মাতলা নদীর পূর্ব দিকে ২৫৮৪.৮৯ বা কমবেশি ২৫৮৫ বর্গ কিলোমিটার পুব বাদা নিয়ে ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করল সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ। এর ১৩৩০.১০ বা কমবেশি ১৩৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে কোর ঘোষণা করা হয়। এবং তা মৎস্যজীবীদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। (সেইসঙ্গে আরবেসি কাটুয়াঝুড়ি ব্লকের ২৪১.০৭ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল সাবসিডিয়ারি উইল্ডারনেস জোন ঘোষণা করে সেটিকে মাছ শিকার এলাকার বাইরে রাখার কথা হয়েছিলতবে, কার্যত, জেলেরা সেখানে মাছ ধরতে পারত।) আবার, ১৯৭৬ সালে পঞ্চমুখানি (১-৫) ও পিরখালি (১-৭) এই দুই ফরেস্ট-ব্লক নিয়ে মোট ৩৬২.৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা স্যাংচুয়ারি ঘোষণা (Sajnekhali WildlifeSanctuary vide Notification No. 5396-For, dt.24.06.1976) করে দেওয়া হল।

সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভে খোলাবাদা অর্থাৎ মাছ ধরার জায়গা রইল কতটা? তা বুঝতে হলে কোর এবং সজনেখালি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি এই দুটি এলাকাকে সমগ্র সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ এলাকা থেকে বিয়োগ করতে হবে। তাতে যা দাঁড়ায় তা হল ২৫৮৪.৮৯ বর্গ কিলোমিটার (১৩৩০.১০ + ৩৬২.৪০) = ৮৯২.৩৯ বর্গ কিলোমিটার। সুতরাং ২৫৮৪.৮৯ বর্গ কিলোমিটার সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের মধ্যে ১৬৯২.৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মৎস্যজীবীদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো তাদেরকে শুধুমাত্র দেওয়া হল ৮৯২.৩৯ বর্গ কিলোমিটার।     

জেলেদের কাছে, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের অন্তর্গত এই ১৬৯২.৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্ধবাদা হিসাবে চেনা। এই বন্ধবাদার অন্তর্ভুক্ত ফরেস্ট-ব্লক ও তার কম্পার্টমেন্টগুলি হল মাতলা (১-৪), চামটা (৪-৮), ছোটোহরদি (১-৩), গোয়াসাবা (১-৪), গোনা (১-৩), বাগমারা (২-৮), মায়াদ্বীপ (১-৫), পঞ্চমুখানি (১-৫) এবং পিরখালি (১-৭)। মৎস্যজীবীদের অভিজ্ঞতায়, সারা সুন্দরবনের মোট মাছের ৭০ শতাংশ মেলে এই ১৬৯২.৫০ বর্গ কিলোমিটার বন্ধবাদায়।     

এইভাবে ১৯৭৬ সালের পর সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের মধ্যে রয়ে গেল ৮৯২.৩৯ বর্গ কিলোমিটার খোলাবাদা (পুব বাদার রিজার্ভ ফরেস্ট)। (এখানে উল্লেখ্য যে, ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান অনুযায়ী, এর মধ্যে নিষিদ্ধ এলাকা হিসাবে ২৪১.০৭ বর্গ কিলোমিটার সাবসিডিয়ারি উইল্ডারনেস থাকলেও জেলেদের এখান থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। সেকারণে তারা এটাকে খোলাবাদার মধ্যে ধরত।) যাইহোক, সমগ্র খোলাবাদার অন্তর্ভুক্ত ফরেস্ট-ব্লক ও তার কম্পার্টমেন্টগুলি ছিল আরবেসি (১-৫), ঝিলা (১-৬), কাটুয়াঝুড়ি (১-৩), হরিণভাঙ্গা (১-৩), চামটা (১-৩), বাগমারা (১), নেতিধোপানী (১-৩) এবং চাঁদখালি (১-৪)। মৎস্যজীবীদের মতে, সুন্দরবনে যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় তার মাত্র ১৫ শতাংশ মেলে এই খোলাবাদায়।

২৫৮৫ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চলে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে যেখানে কমবেশি ৮,০০০  নৌকা মাছ শিকার চলতো। সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার মাত্র ওই ৮৯২.৩৯ বর্গ কিলোমিটার খোলাবাদা এলাকায় মাছ শিকারের জন্য ১৯৮০ সাল নাগাদ মাত্র ৯২৩ টি নৌকাকে বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) দেওয়া হলো।  

১৯৭৩ সালে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার বাইরে অর্থাৎ মাতলা নদীর পশ্চিম দিকের ১৬৭৯.১১ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিম বাদা আগের মতোই রিজার্ভ ফরেস্ট হিসাবে রয়ে গেল। প্রায় তিন বছর পর ১৯৭৬ সালে সেই বনাঞ্চলের ৫.৯৫ বর্গ কিলোমিটার হেলিডে আইল্যান্ড (যা ডুলিভাসানি ফরেস্ট-ব্লকের ৭ নং কম্পার্টমেন্টের ক্ষুদ্র অংশ) এবং ৩৮ বর্গ কিলোমিটার লোথিয়ান আইল্যান্ড (যা সপ্তমুখি ফরেস্ট-ব্লকের ১ নং কম্পার্টমেন্টভুক্ত) এই দুই এলাকা নিয়ে মোট ৪৩.৯৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা যথাক্রমে Notification No.5388-For, dt. 24.06.1976 এবং Notification No. 5392-For, dt. 28.06. 1976 এই দুটি নোটিফিকেশন দ্বারা স্যংচুয়ারি বলে ঘোষণা করে দেওয়া হলো। সেখানে সারা সুন্দরবনের মোট মাছের মাত্র ৫ শতাংশ মাছের সন্ধান মেলে। বাকি ১৬৩৫.১৬ বর্গ কিলোমিটার রিজার্ভ ফরেস্টে মেলে সুন্দরবনের মোট মাছের মাত্র ১০ শতাংশসেই ১০ শতাংশ মাছ ধরার জন্য কমবেশি ৩৭০০ নৌকাকে বিএলসি অর্থাৎ মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হলো

প্রায় ৪২৬৪ বর্গ কিলোমিটার সুন্দরবনে দাঁড়পাল নৌকা ও মেশিন নৌকা মিলে কমবেশি ১০০০০ নৌকা মাছ শিকার করে। সাধারণভাবে একটি নৌকায় কমবেশি তিন জন মৎস্যজীবী শিকারে যান। তবে অনেক ক্ষেত্রে লম্বা নৌকায় ১০-১২ জনও মাছ শিকারে যান। আবার অসংখ্য লোক নিজেদের গ্রাম লাগোয়া বনাঞ্চলের গাঙ্গে মাছ শিকার করেন যাদের মাছ ধরার জন্য নৌকার দরকার হয় না (উদাহরণস্বরূপ - বকখালি অথবা ধঞ্চি ফরেস্ট)। সবমিলিয়ে সুন্দরবনে মোট মাছ শিকারির সংখ্যা লক্ষাধিক।           

যাইহোক, সমস্ত মাছ ধরার নৌকার মধ্যে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের জন্য ৯২৩ টি  এবং  সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের বাইরের রিজার্ভ ফরেস্টের জন্য ৩৭০০ টি সবমিলিয়ে মোট ৪৬২৩ টি নৌকাকে সুন্দরবন জঙ্গলে মাছ ধরার জন্য বিএলসি দেওয়া হল। এইভাবে সুন্দরবনের লক্ষাধিক মৎস্যজীবীর মধ্যে মাত্র ১৪-১৫ হাজার মানুষকে সুন্দরবন জঙ্গলে মাছ ধরার সুযোগ করে দেওয়া হলো      

কিন্তু, পেটের জ্বালাতো আর আইন মানবে না। স্রেফ পেটের টানে লক্ষাধিক লোক অনুমতি ছাড়াই নিত্য মাছ ধরতে থাকে তাদের পুরানো মাছ ধরার জায়গায় ঘরেকাছে কোনো এলাকায় কিংবা আরও দূরের চেনা এলাকায় সেই জায়গা কোর, বাফার বা স্যাংচুয়ারি যাই হোক না কেনো অতএব, বংশ পরম্পরায় যেসব এলাকা তাঁদের নিত্য জীবিকা স্থান ছিল, সেখানে তাঁরা এখন অবাঞ্ছিত আইনের ভাষায় অনুপ্রবেশকারী। আর সেই কারণে ফরেস্ট গার্ডদের হাতে ধরা পড়লে তাদের জুটতে থাকে অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা।

কী নেই তাতে? মোটা অঙ্কের ঘুষ। না দিতে পারলে জাল নৌকা কেড়ে নেওয়া। মারধর খাওয়া। লাথি দিয়ে নৌকা থেকে খাবারের জল ফেলে দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনা। সেই সঙ্গে চলে মাছ-কাঁকড়া কাড়া। মেশিন নৌকা হলে তেলের টেঙ্কিতে জল ঢেলে দেওয়া। মেশিনের হ্যান্ডেল নিয়ে চলে যাওয়া। নৌকার হাল দাঁড়কে ভাটির টানে ভাসিয়ে দেওয়া।      

আর সেই সব ফরেস্ট বাবুদের হাত থেকে বাঁচতে জঙ্গলের সরু খালে ঢুকে অনেক মৎস্যজীবীকে বাঘের হাতে প্রাণ দিতে হয়। সামান্য একটু রোজগার করতে গিয়ে মৎস্যজীবীদের গোটা পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যায়।

আবার, যাঁদের বিএলসি আছে তাদেরও অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা নেই। কেননা, খোলাবাদায় মাছ কোথায়? তাতে ট্রিপের খরচই হয় না, বউ বাচ্চাকে খাওয়াবে কী? তাই  মাছের জন্য তারাও ঢুকে পড়ে কোর বা স্যাঙ্কচুয়ারিতে। আর ধরা পড়লে নৌকার প্রত্যেক জেলে পিছু ১১৫০ টাকা করে জরিমানা দিতে হয় প্রথমবারের জরিমানা দ্বিতীয়বারে দ্বিগুণ হয়ে যায়। তৃতীয়বারে ফের দ্বিতীয়বারের দ্বিগুণ। চতুর্থবার ধরা পড়লে দেয় তৃতীয়বারের দ্বিগুণ। এইভাবে, সরকারি আধিকারিক ও কর্মচারীদের যথেচ্ছাচারে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে জরিমানার বহর। 

অনেক ফরেস্ট অফিসারের আবার মরজি হলে জরিমানা দিতে হয় না। তার বদলে বিনা রসিদে দিতে হয় বড় অঙ্কের ঘুষ। সেই ঘুষ দিতে না চাইলে ফরেস্টবাবুরা বিএলসি তুলে নিয়ে গিয়ে গনের পর গন কোন অজানা ফরেস্ট অফিসে আটকে রাখে। আর তা না হলে, জাল নৌকাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফরেস্ট অফিসের সরু খালে কিংবা ডাঙায় তুলে রেখে দেয়। এসব বহুবিধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করলেই জুটবে লাথি লাঠিপেটা আর গালাগালি। জলে নেমে কুমিরের সাথে লড়াই? তার চেয়ে মানে মানে ঘুষের মোটা অঙ্ক ফরেস্টবাবুদের হাতে গুঁজে দিয়ে মাথা নত করে বেরিয়ে আসতে হয় মৎস্যজীবীদের

 

এইভাবে সময় এগোতে থাকে। বিএলসির নৌকাগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একে একে পুরানো হয়ে ভেঙ্গে যায়। আবার বিএলসি মালিকদের কেউকেউ ফরেস্ট বাবুদের নিত্য ঝুটঝামেলা অত্যাচার অপমান এড়াতে পেশা বদলে নেন। কেউ কালের নিয়মে একদিন মরে যান। কেউবা যান বাঘের পেটে। কেউবা চলে যান রোগ শয্যায়। স্বাভাবিক নিয়মেই এদের বিএলসিগুলি বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেগুলির অনেকগুলিই কোনো এক অদৃশ্য কারণে বাতিল হয় না। আবসেন্টি ওনারের বিএলসি হিসাবে সেগুলি ভাড়ায় চলতে থাকে। আবার, নৌকার বিএলসি বাতিল হলে বনদপ্তর অন্যকোন যোগ্য মৎস্যজীবীর নামে তা পুনরায় ইস্যু করার আর কোনও উদ্যোগ নেয় না।

 

   যাঁদের বিএলসি নেই তারা মারধর আর চোর বদনামের হাত থেকে বাঁচতে বিএলসি বছর চুক্তিতে ভাড়ায় নেয়। তাতে অ্যাবসেন্টি বিএলসি মালিকরা জঙ্গলে না গিয়েই বছর বছর আয় করে চলেন। ভাড়ার বিএলসির সংখ্যার চেয়ে, বিএলসির চাহিদা অনেক গুণ বেশি। তাই প্রতিযোগিতার বাজারে বছর পর বছর  বিএলসির ভাড়া চরচর করে বাড়তে থাকে। এইভাবে বিএলসির ভাড়া বাড়তে বাড়তে এখন বছরে একটি বিএলসির ভাড়া লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

 

    অন্যদিকে, উচ্চ ভাড়ার বিএলসি নিয়ে যেখানে মাছ ধরা হবে, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সেই খোলাবাদা এলাকার আয়তন কিন্তু কমে গেল। ২০০৭ সালে কোর এরিয়াকে ক্রিটিক্যাল টাইগার হেবিটেট (CTH)  ঘোষণা করার সময়  বনদপ্তর খোলাবাদার ৩৬৯.৫৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে (চামটা ১-৩, বাগমারা ১, নেতিধোপানী ১-৩ এবং চাঁদখালি ১-৪) ক্রিটিক্যাল টাইগার হেবিটেট (CTH)  ঘোষণা করে খোলাবাদার আয়তন মাত্র (৮৯২.৩৯ ৩৬৯.৫৩ = ৫২২.৮৫)  ৫২২.৮৬ বর্গ কিলোমিটারে নামিয়ে আনল। এইটুকু খোলাবাদাকে সজনেখালি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির সঙ্গে জুড়ে ২০০৯ সালে নাম দেওয়া হল বাফার (Notification No. 615-For/11M-28/07, dated 17.02.2009)। বলা বাহুল্য যে, কাগজে কলমে সজনেখালি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারিটি বাফারের অভ্যন্তরে রাখা হলেও, তাতে মৎস্যজীবীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। বাফারে মাছ শিকারে গিয়ে জেলেরা নিত্য ঠক্কর খেতে লাগল, এর মধ্যে কোন জায়গাটা খোলা আর কোন জায়গাটা বন্ধ, এই ধন্ধে।  

 

অন্যদিকে, ২০১৩ সালে পশ্চিম বাদা অর্থাৎ  রিজার্ভ ফরেস্টের ১৬৩৫.১৬ বর্গ কিলোমিটার মাছ ধরার জায়গার মধ্যে ৫৫৬.৪৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গাকে ওয়েস্ট সুন্দরবন ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Notification No. 1828-For, dt. 11.09.2013) ঘোষণা করে মাছ ধরার জায়গার আয়তন ১০৭৮.৭১ বর্গ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হলো এইভাবে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছেন মৎস্যজীবীরা।

এইভাবে মার খেতে খেতে পিছু হটতে হটতে সেই ১৯৭৩ সাল থেকে মৎস্যজীবীদের জীবনের ৫০ বছর কেটে গেছে। আর এই ৫০ বছরে মৎস্যজীবীরা কী পেলেন?    

গত ৫০ বছরে ফরেস্ট অফিসগুলোতে সুন্দরবনের হতদরিদ্র প্রান্তিক জেলেদের আটক করা প্রায় ৫০ হাজার নৌকা পড়ে পড়ে পচে নষ্ট হয়ে গেছেযেগুলোর মাপ ও (নির্মাণ সামগ্রীর) গুণমান অনুযায়ী প্রতিটার দাম ৩০ হাজার থেকে ৩ লাখ। গড়ে নৌকা পিছু ৫০ হাজার টাকা করে মূল্য ধরলে মোট ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি ২৫০ কোটি টাকা। ফরেস্ট অফিস গুলোতে সুন্দরবনের হতদরিদ্র প্রান্তিক জেলেদের  প্রায় ৫ লাখ  আটক করা জাল পড়ে পড়ে নষ্ট হয়েছেযেগুলোর প্রতিটার দাম ৩ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। গড়ে জাল প্রতি ৫ হাজার টাকা করে ধরলে মোট ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি ২৫০ কোটি টাকা।

 

গত ৫০ বছরে পেটের দায়ে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের মুখে প্রাণ দেওয়ায় বিধবা হয়েছেন প্রায় ৮ হাজার মহিলা। এধরণের ক্ষতির অর্থমূল্য কত? একজন মৎস্যজীবীর জীবনের মূল্য তার নিজের, তার পরিবার, তার বন্ধুবান্ধব ও বৃহত্তর সমাজের কাছে কত, তা অর্থমূল্যে উল্লেখ করা কঠিন। সরকার অবশ্য ক্ষতিপূরণের অর্থমূল্যের হিসেবে একভাবে মৎস্যজীবীর জীবনের এক ধরনের দাম হিসাব করেছে। ব্যাঘ্র-দুর্ঘটনায় মৃত ১ জন মৎস্যজীবীর বর্তমান সময়ে ক্ষতিপূরণ বনদপ্তর থেকে ৫ লাখ, প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনা থেকে ৫ লাখ, মৎস্যজীবী বন্ধু প্রকল্প থেকে ২ লাখ এবং জাতীয় পরিবার সহায়তা প্রকল্প (NFBS) থেকে  ৪০ হাজার টাকা, সব মিলিয়ে মোট ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। (ব্যাঘ্র-দুর্ঘটনায় মৃত মৎস্যজীবীর পরিবার এই সমস্ত ক্ষতিপূরণ আদৌ পায় কিনা সেটা আলাদা প্রশ্ন।) সুতরাং গত ৫০ বছরে বাঘ-দুর্ঘটনায় মৃত ৮ হাজার মৎস্যজীবীর ক্ষতির পরিমাণ বর্তমান মূল্যে ৯৯২ কোটি টাকা। আর, গত ৫০ বছর ধরে লক্ষাধিক হতদরিদ্র প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের উপরে চলা মারধর রক্তপাত গালাগালি অশ্রুবিসর্জন অপমান এসবের অর্থমূল্য কত?  

এই সমীকরণের অন্য দিকটিতে, গত ৫০ বছরে সুন্দরবন থেকে রাজ্য তথা দেশ তথা বিশ্বসমাজ কী পেল? ১০৩ টি বাঘ। র ৭৯টির বাস সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভে। বাকি ২৪ টি রিজার্ভ ফরেস্টে। এর মূল্য বৃহত্তর সমাজের বদলে শুধু মৎস্যজীবীদের দিতে হবে কেন?

     যখন সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার কোনও আইনি ভিত্তি ছিল না। বিএলসির আইনি ভিত্তি কী বা সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ-এ ৯২৩টি বিএলসি কেন, তার কোন সদুত্তর সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। ২০১৩ সালে ওয়েস্ট সুন্দরবন ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি ঘোষণা করার আগে তার উপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করার ও তাদের সম্মতি নেওয়ার কোন প্রয়োজন বনদপ্তর অনুভব করেনি। আবার এখন রিজার্ভ ফরেস্টের তিনটি রেঞ্জ মাতলা, রায়দিঘি ও রামগঙ্গা রেঞ্জ-এর ১০৪৪.৬৮ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের অন্তর্ভূত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগেও মৎস্যজীবীদের সঙ্গে আলোচনা পর্যন্ত করা হয়নি, তাদের সম্মতি নেওয়া তো দূরের কথা।

এই ষড়যন্ত্রের ফলে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের বাইরে এবং  রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে পড়ে থাকবে শুধুমাত্র দুটি রেঞ্জ ভগবতপুর রেঞ্জ এবং নামখানা রেঞ্জ। মৎস্যজীবীদের সুন্দরবন থেকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রের যে ধারা গত ১০০ বছর ধরে অব্যহত রয়েছে সেই ধারার শেষাংশ হিসাবে অচিরেই এই দুটি রেঞ্জও সুন্দরন টাইগার রিজার্ভের ভেতর ঢুকে পড়বে।

 

আসন্ন দুর্দিন শুধু সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের নয়, সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতেও দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। গণমাধ্যমে খবর হয়, কোনও না কোন গ্রামে বাঘ ঢুকেছে। কিন্তু প্রশ্ন, কেন গ্রামে বাঘ ঢুকছে? উত্তরটা আজকাল প্রায় সকলেরই জানা। তা হল, জঙ্গলে প্রয়োজনীয় খাবার পাচ্ছে না রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। পাবে কী করে? একটি বাঘের দিনে ৫ থেকে ১৫ কিলোগ্রাম মাংস লাগে। পুরুষ বাঘ একদিনে ৩০ কিলোগ্রামও খেয়ে ফেলতে পারে। মাঝে মাঝে বাঘ উপোষেও থাকে। তাই গড়ে যদি বাঘ পিছু দিনে ১০ কিলোগ্রাম মাংস ধরা হয় তবে বছরে অর্থাৎ ৩৬৫ দিনে বাঘ পিছু মাংস লাগবে ৩.৬৫ টন মাংস

 

সেই হিসাবে, সুন্দরবনে বর্তমানে ১০০ টি বাঘের জন্য বছরে প্রয়োজন ৩৬৫ টন মাংস। যদি পূর্ণ বয়স্ক বুনো শুয়োর বা চিতল হরিণের গড়ে ওজন ৫০ কিলোগ্রাম হয়, তাহলে বছরে ১০০ টা বাঘকে খাওয়াতে ৭৩০০ টি বুনো শুয়োর, চিতল হরিণ ইত্যাদি লাগবে। তাছাড়া জঙ্গলে শেয়াল, বাগরোল ইত্যাদি প্রাণীও আছে। তাদেরও তো কিছু মাংস লাগবে। তাই এতোগুলো প্রাণী বছরে নিহত হলে কদিন সুন্দরবন ১০০ টা বাঘকে খাবার জোগাবে? তাছাড়া ১০০ টা বাঘ থেকে আগামী দিনে বাঘের সংখ্যাও তো বাড়বে। আনুষঙ্গিক পরিকল্পনা ছাড়া আগামী দিনে বাঘের সংখ্যা বাড়লে খাবারের সন্ধানে সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে মুহুর্মুহু বাঘ ঢুকে পড়াটা আটকাবে কে?  

 

    উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আর একটা প্রশ্ন সবার মনে উঁকি দেয় না কি, ১০৩ টি বাঘের খোরাকের জন্য খাদ্য-খাদকের অমোঘ নিয়মে সুন্দরবন জংগলের অন্তরালে নিত্য যে বিশাল সংখ্যক বন্যপ্রাণ সংহার চলছে, তাতে জঙ্গলে বাঘ ভিন্ন অন্যান্য বন্যপ্রাণ টিকে আছে তো? আর যদি সেগুলি টিকে থাকে তাহলে একটা সন্দেহ অবশ্যই রয়ে যায়, আদৌ ১০৩ টি বাঘ সুন্দরবনের জঙ্গলে আছে তো? নাকি গত ৫০ বছর ধরে বহু অর্থ, বহু অত্যাচার, অবিচারের বিনিময়ে, সংরক্ষণের চূড়ান্ত ফল হিসাবে দেখানো, ১০৩ টি বাঘের গল্পের পেছনে আছে অন্য কোনো গল্প? 

       

লোক দেখানে, জঙ্গলের উপর বনজীবীদের নির্ভরতা কমাতে এবং গ্রামে বাঘ ঢুকলে গ্রামবাসীরা যাতে তাকে মেরে না ফেলে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তা নিশ্চিত করতে, জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিকে বনদপ্তর জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি (জেএফএমসি)-র আয়তায় এনে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করছে।

    কিন্তু সেই গ্রামগুলিতে উন্নয়ন করা বনদপ্তরের আসল উদ্দেশ্য মোটেই নয়। বনদপ্তরের আসল উদ্দেশ্য, কারা অনুমতি ছাড়া জঙ্গলে মাছ শিকারে যাচ্ছে, জেএফএমসি মেম্বারদের মাধ্যমে, তাদের খবর সংগ্রহ করা। আর, জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে জেএফএমসি মাধ্যমে বিশেষ আর্থিক সুবিধা দিয়ে বনদপ্তর ঐ গ্রাম্যগুলিকে অন্য গ্রামগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে এতে তৈরি হয় সুবিধাহীন এবং সুবিধাপ্রাপ্ত গ্রামগুলির মধ্যে বৈরী সম্পর্ক। যাতে অদূর ভবিষ্যতে যখন বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র বাড়ানোর জন্য জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিকে সরানোর প্রয়োজন হবে তখন যেনো সুবিধাহীন গ্রামগুলো প্রতিহিংসা বশত চুপ থাকে। তাতে খুব সহজেই বনদপ্তর জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলি থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে পারবে। অবশ্য এইসব বাস্তব ও সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলির সবই নেওয়া হবে দুর্ভাগা মৎস্যজীবী ও সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের বিরুদ্ধে। তবে পর্যটন ব্যবসায়ী ও তাদের হোটেলগুলোতে বনদপ্তর হাত দেয় না, কখনও দেবে না।

    পরিশেষে, গত ১০০ বছর ধরে সুন্দরবন জঙ্গল থেকে বনজীবীদের জীবিকাকে উৎখাত করার যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, উৎখাতের লাইনে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মৎস্যজীবীরা, যারা মাছধরার জীবিকা থেকে উৎখাত হতে চলেছেন। আর, উৎখাতের পরের সারিতে রয়েছেন জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির মানুষজন, যারা জীবিকার পাশাপাশি বসতি থেকেও উৎখাত হতে চলেছেন।

এককথায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কিছু তথাকথিত বন্যপ্রাণপ্রেমী এনজিও এবং পর্যটন পুঁজির মিলিত দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রে সুন্দরবনের লক্ষাধিক প্রান্তিক মৎস্যজীবী বিপদে পড়তে চলেছেন।



* অনতিদূর অতীতে এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ২০০৩ সালে জম্বুদ্বীপ থেকে প্রায় ১০ হাজার মৎস্যজীবীকে সাবাড়-জীবিকা (মাছ শুকিয়ে বিক্রির জীবিকা) থেকে উৎখাত করা হয়

========= 0 ==========

Milan Das,

Address:

Vill.- Ramrampur (Halderpara),

P.O.- Diamond Harbour,

District- South 24 Parganas,

State - West Bengal,

India,

Pin- 743331 

Mob.: +91 9800266265

E-mail: mdas1640@gmail.com

 

   

 

  

Comments

Popular posts from this blog

Unchecked avarice and abuse of power push Sundarban fishers to the brink

আজ আমি শুধু তোমাদের মেয়ে ---- দ্বৈপায়ন দত্ত